সৈয়দ আল্লামা ইমাম হায়াত আলাইহি রাহমার " রমজানের জরুরী আহবান "
" রমজানের জরুরী আহবান "
===================
রোজা ঈমানদারদের জন্য আত্মিক উন্নয়ন ও সাফল্য লাভ এবং বিপর্যয় থেকে রক্ষায় এক অপরিহার্য্য দ্বীনী স্তম্ভ ও জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ, যার মূলে রয়েছে দয়াময় আল্লাহ্তাআলা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমের অভিযাত্রা ও নৈকট্য সাধনা এবং যার শর্ত হলো আত্মার ঈমানী শুদ্ধতা।
আল্লাহ্তাআলা কুরআনুল করীমে রোজার নির্দেশক আয়াত শরীফে প্রথমে ঈমানের কথা বলেছেন। সব মানুষের জন্য নয়, কেবল ঈমানদারদের জন্যই রোজা ফরজ করেছেন এবং অন্যসব এবাদত আমলের পুর্বেও ঈমানকেই প্রথম ও মুল শর্ত করেছেন। ঈমান ব্যতীত আমল কবুল হয় না এবং শুধু আমল নয় মুসলিম হওয়ার বা দাবীর মুল শর্তও কেবল ঈমান। ঈমানের ভিত্তিতেই সত্যভিত্তিক জীবন, ঈমানের বিপরীতে মিথ্যাভিত্তিক জীবন। মিথ্যাভিত্তিক আত্মা ও জীবনের আমল মিথ্যারই অংশ বিধায় গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
ঈমান কেবল আল্লাহ্তাআলাকে যেনতেন ভাবে বিশ্বাস বা উপাসনার নাম নয়, আল্লাহ্তাআলাকে অমুসলিমরাও তাদের মত করে বিশ্বাসের কথা বলে, উপাসনা করে, আখেরাতেও বিশ্বাস করে, পাপ পুণ্য, ন্যায় অন্যায়ের কথাও বলে, কিন্তু আল্লাহ্তাআলার রেসালাতে বিশ্বাস করে না, বিচ্ছিন্নভাবে কোন নবী রাসুলকে তাদের মত করে স্বীকার করলেও পুর্বাপর রেসালাতের অবিচ্ছিন্ন ধারা এবং মূল রেসালাতে ইলাহীতে বিশ্বাস করে না। রেসালাতে বিশ্বাস ও কবুল ব্যতীত তাওহীদের সম্পর্ক পাওয়া যায় না, রেসালাতই ইলাহিয়াতকে পাওয়ার মূল ঠিকানা ও কেন্দ্র এবং মূল আলো ও রহমত। নবুওত রেসালাত কবুল না করার জন্যই ইবলিছ বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হয়েছিল। নবুওত রেসালত অগ্রাহ্য করলে বিচ্ছিন্ন হলে সে তাওহীদ ইলাহিয়াত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রেসালাতে সংযুক্ত থাকলেই কেবল ইলাহিয়াতে সম্পর্কিত থাকে, নতুবা নয়। রেসালাতই আল্লাহতাআলার নূর, আছমা, ছেফাত ও ওয়াহীর প্রকাশস্থল, যা অস্বীকার পরোক্ষ তাওহীদেরই অস্বীকার। হেদায়াত, রহমত, জ্ঞান, নাজাত সব রেছালাতের মাধ্যমেই এসেছে এবং অনন্তকাল প্রবাহিত হতে থাকবে। মহান রেসালাতকে জীবনের সব সম্পর্কের উর্ধ্বে স্থান দেয়াই ঈমানের প্রাণ এবং তাওহীদের প্রতি সর্বোচ্চ ভালবাসা।
ঈমান আত্মা ও জীবনের সবচেয়ে বড় সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন বিষয়, জীবনের আসল পরিচয়। ঈমান তাওহীদ রেসালাতের কেবল বাহ্যিক স্বীকার বা উচ্চারন নয়, আত্মায় কবুল করা, জীবন আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হয়ে যাওয়া, তাওহীদ রেসালাতের বিপরীত মত পথ দর্শন থেকে মুক্ত হওয়া। পবিত্র কলেমাভিত্তিক আত্মসত্ত্বা ও জীবনচেতনার বিপরীত অবস্থান থেকে মুক্ত না হয়ে কলেমার নিছক উচ্চারন স্ববিরোধী অবস্থান। ঈমানের পবিত্র কলেমায় আমরা রেছালাত কেন্দ্রিক তাওহীদ ভিত্তিক আত্মসত্ত্বা ও জীবন চেতনার শপথ নেই, অন্তর্ভুক্ত হই এবং এর বিপরীত থেকে মুক্ত হই।
তাওহীদের বিপরীত নাস্তিকতা, নাস্তিকতা থেকে উদ্ভূত বস্তুবাদ অর্থাৎ বস্তুভিত্তিক আত্মসত্ত্বা ও জীবন চেতনা এবং বিভিন্ন বস্তুবাদী ধ্বংসাত্মক মতবাদ। তাওহীদ ইলাহীয়াতের প্রতিষ্ঠান রেসালাত, মহান রেসালাতকে কেন্দ্র করে তাওহীদী জীবন তথা ঈমানী জীবন। বস্তুকে আত্মপরিচয় ও জীবন জাতীয়তার মূল করে বস্তুর ভিত্তিতে বস্তুবাদী বস্তুপুজারী তথা নাস্তিক্যবাদী জীবন। ঈমানী আত্মসত্ত্বা রেছালাতকে অবলম্বন করে তাওহীদ ভিত্তিক হয়, আর বস্তুবাদী আত্মসত্ত্বা ভাষা, গোত্র, রাষ্ট্র, লিংগ, প্রকৃতি, প্রভৃতি বস্তুর ভিত্তিতে হয়। বস্তু মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহতাআলার দান, মানবসত্ত্বার উর্ধ্বে নয়। রেসালাতে ইলাহী ভিত্তিক আত্মসত্ত্বা, আত্মপরিচয়, আত্মউপলব্ধি তথা কলেমা ভিত্তিক জীবন চেতনা ব্যতীত কলেমার নিছক উচ্চারন কেবলই শব্দ, ঈমান নয়।
কলেমা তথা তাওহীদ রেসালাত ভিত্তিক জীবন চেতনার অন্যতম মৌলিক তাৎপর্য ও প্রতিফলন বস্তুগত দাসত্ব থেকে আত্মার মুক্তি, জীবনের স্বাধীনতা, সম্মান, নিরাপত্তা, অধিকার, মালিকানা, বিকাশ ও প্রগতি, সব অবৈধ কর্তৃত্ব ও জবরদস্তির অবসান, মুক্ত ব্যক্তিসত্ত্বা। যারা ইসলামের নামে বেনামে, আল্লাহরআইন, শরিয়ত বা যে কোন শব্দের অপব্যাখ্যা অপব্যবহার করে ধর্ম আদর্শ নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের বৈধ মৌলিক অধিকার সম্মান স্বাধীনতা বিকাশ প্রগতি হরন করে, আতংক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, মানবতা ধ্বংস করে, জীবন বিনাশ করে তারা কলেমার বিপরীত, ঈমান ও দ্বীনের ধ্বংসাত্মক শত্রু, আইয়ামে জাহেলিয়াতের ধারক খোদাদ্রোহী নবীদ্রোহী এজিদবাদী কুফরী চক্র। তাওহীদ রেসালাতের পরে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাই কলেমার সবচেয়ে বড় দান, মানবতাই দ্বীনের সর্বোচ্চ বিষয়, যা লংঘন কলেমার চেতনারই অস্বীকার। মুসলিম বা ঈমানদার দাবী করেও যারা মানবতা ধ্বংস করে তাদের ঈমান নেই এবং তারা মুসলিমও নয়।
নামাজ ও রোজা সহ সব এবাদতের পূর্বে হক বাতেল জেনে নিজের অবস্থান ঠিক করে নিতে হবে, কারণ অস্তিত্ব ও এবাদতের পূর্বশর্ত ঈমান। হক আকিদাই ঈমানের ভিত্তি এবং কোন আমল বা সুরত নয় একমাত্র ঈমানই মুসলিমত্বের ভিত্তি। ঈমানহীন আমল প্রাণহীন দেহের মত। বাতেল আকিদায় আমলের কোন মূল্য নেই। কোন বাতেল দল মতে থেকে মুসলিম দাবী মদ্যপানরত অবস্থায় রোজাদার দাবীর মতই মিথ্যা। ঈমান তথা মুমিন জিন্দেগীর পূর্বশর্ত সব বাতেল দলমত থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহতাআলার উদ্দেশ্যে রেসালাতেইলাহী মহান প্রিয়নবীর প্রতি পূর্ণাংগ বিশ্বাস, প্রাণাধিক ভালবাসা, প্রিয়নবীকেন্দ্রিক আত্মসত্ত্বায় অটল হয়ে সত্যের চিরন্তন ধারা তথা খোলাফায়ে রাশেদীন, আহলে বায়েত, সত্যের ইমামবৃন্দ ও আওলিয়াকেরামের সম্পর্কে যুক্ত থাকা, যারা এ ধারা থেকে বিছিন্ন তাদের আত্মা মৃত এবং ঈমান থেকেই বিচ্ছিন্ন ।
আত্মিক শুদ্ধি নয় আত্মিক উন্নতির জন্যই রোজা, বাতেলগ্রস্ত মিথ্যার ধারক দূষিত অশুদ্ধ আত্মার উন্নতি অসম্ভব। বাতেল দলমত নেতৃত্ব তথা মিথ্যা ও জুলুমের সম্পর্কই আত্মা দূষিত করে। ঈমান তথা সত্যে অটলতা এবং প্রিয়নবীর পরম ভালবাসাই আত্মিক শুদ্ধির আলো। আত্মার মূল, অস্তিত্ত্বের উৎস মহান রাসুল থেকে কোন ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলে রাসুল কেন্দ্রীক না হয়ে বস্তুভিত্তিক হয়ে থাকলে আত্মা মৃত অন্ধকার ও নাপাক হয়ে যায়,যেখানে নামাজ রোজা বা কোন এবাদতই আর কোন কাজে আসে না। প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য রোজা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। কিন্তু মিথ্যা ও জুলুমের সম্পর্ক থেকে আত্মার মুক্তি ব্যতিত প্রবৃত্তি মুক্তির চেষ্টা অবান্তর। হাদিছ শরীফ অনুযায়ী শুধু ঈমান নয়, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, অহংকার, অন্যের অনিষ্ট ইত্যাদি অসৎ স্বভাব থেকে মুক্ত হওয়া এবং সৎ গুনাবলী অর্জন করাও এবাদত কবুল হওয়ার জরুরী শর্ত যা তরিকতেরও মুল বিষয় এবং আমলের চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ।
পবিত্র রমজানে অবশ্যই কোরআনুল করীম তেলাওয়াত করতে হবে, কিন্তু অপব্যাখ্যার শিকার হওয়া যাবে না, ওহাবী, মওদূদী, তবলীগী, শিয়া, কাদিয়ানী, সালাফী প্রভৃতি বাতেল ফেরকার বই পুস্তক ওয়াজ তফসির ঈমান হানিকর অপব্যাখ্যা। কোরআন পাকের সব আয়াতের অভিধানিক অর্থ গ্রহণ আল্লাহতাআলা নিজেই নিষিদ্ধ করেছেন, (সুরা আল ইমরান আয়াত-৭)। অতএব ঈমান হারা না হয়ে সত্যে অটল থাকতে হলে কেবলমাত্র মহান আহলে বায়েত, খোলাফায়ে রাশেদীন, সত্যের ইমামবৃন্দ ও আওলিয়াকেরামের পথ আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দিশায় যুগের সঠিক দিকদর্শনে থাকতে হবে।
ন্যায়, শান্তি, স্বাধীনতা, অধিকার, নিরাপত্তা, সেবা, মানবতা, ভালবাসা, জ্ঞান, প্রগতি ও গণতন্ত্রের ধারক রক্ষক প্রকৃত ইসলামের ধারকদের বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী না থাকায় সভ্যতা মানবতা স্বাধীনতা বিপন্নকারী মিথ্যা বর্বরতা জুলুম আগ্রাসনের ধারক বিভিন্ন অপশক্তির সাথে সাথে ইসলামের ছদ্মবেশী বর্বর পাশবিক শক্তি প্রকৃত ইসলামকে বিলুপ্ত করে তাদের কুফর মিথ্যা জুলুম স্বৈরতাকে ইসলাম হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রকাশ্য অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে অক্ষম হওয়ায় সন্ত্রাস ও ইসলামের ছদ্মনামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার জোরে নিজেদের অনাচার চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছে। বিশেষভাবে কেবলাভূমি পবিত্র আল আরবে ঈমানদ্বীন পরিপন্থী গোত্রবাদী সৌদী ওহাবী স্বৈরশাসনের সুযোগে তাদের সহায়তায় ওহাবী সালাফী বোমাবাজ উগ্র জঙ্গিবাদী সভ্যতা মানবতা বিনাশী অপশক্তির উত্থান হচ্ছে। খারেজী ওহাবী জংগীবাদী মাদ্রাসা এবং বিবেকহীন খুনী সন্ত্রাসী দল তৈরী করে এরা এসব অপকর্ম চালাচ্ছে। ঈমান বিনাশ, দ্বীন বিকৃতি, পবিত্র কোরআন হাদিছ শরীফের অপব্যাখ্যা, দ্বীনের নিদর্শন রুহানিয়াতের কেন্দ্র পবিত্র মাজার শরীফ সমূহে হামলা, আইন আমল ফতোয়ার বাড়াবাড়ি জবরদস্তি, অন্যের ব্যক্তিজীবনে অবৈধ অনধিকার হস্তক্ষেপ, বোনদের শিক্ষা মর্যাদা মানুষসত্ত্বা স্বাধীনতা অধিকার হরণ, শরিয়ত সম্মত সুস্থ স্বাভাবিক পর্দার বিপরীতে মনগড়া অতিপর্দার অবরোধ আরোপ, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি প্রগতি ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ ও জিহাদের নামে খুন সন্ত্রাস অপরাধে লিপ্ত এসব বাতেল ফেরকাই আজ ঈমান দ্বীন মিল্লাতের সর্বনিকৃষ্ট প্রধান শত্রু।এসব বাতেলের এক্তেদায় নামাজ ঈমান বিসর্জন দিয়ে আমল তথা গাছের মূল কেটে শাখায় পানি দেয়ার মত এবং এদের মাদ্রাসায় যাকাত ইসলাম ধ্বংসে শত্রুকে সাহায্য করা।
হক ও মানবতা রক্ষার আন্দোলন এবং বাতেল ও জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানী দায়িত্ব অবহেলা করে সত্যের কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কেবল ব্যক্তিগত আমলে সাফল্য আসবে না। সত্যের আপনদের ঐক্যবদ্দ্ব প্রচেষ্টার মধ্যেই সার্বিক মুক্তি এবং সত্য ও মানবতার বিজয়।
---আল্লামা ইমাম হায়াত আলাইহির রাহমা
(ইসলামের মূল ধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রকৃত ধারার এ যুগের পূণরূজ্জীবনকারী এবং বিশ্ব সুন্নী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লবের প্রবর্তক)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks For You Comment